শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৫৪ পূর্বাহ্ন
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, আপনার ঘরে রক্ষিত গ্যাস সিলিন্ডারটি বোমায় রূপান্তরিত হওয়া প্রতিহত করুন। যেকোন দুর্ঘটনা বা ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া আপনার দায়িত্ব। মনে রাখবেন, ফায়ার সার্ভিস বা সিভিল ডিফেন্স আসবে আগুন লাগার পরে, আপনার কাজ আগুন লাগতে না দেওয়া। গ্যাস সিলিন্ডার জনিত দুর্ঘটনা আর সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা এড়িয়ে নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। অসাবধানতা, উদাসীনতা আর অজ্ঞতা – গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদের পরিবারে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করতে পারে। আমরা আপনার সাথে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু টিপস শেয়ার করবো আজকে। যার যার ঘরে LPG (এলপিজি) গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে, তাদের প্রত্যেককে সচেতন হওয়া কিংবা সচেতন করা একান্ত জরুরী।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ১ :: সংরক্ষণ বা স্টোরেজ
এই বিষয়টি গুরুত্বের দিক থেকে সবার উপরে থাকবে। আপনার LPG সিলিন্ডার সংরক্ষণ করবার যথোপযুক্ত স্টোরেজ স্থানটি কেমন হওয়া উচিত? এখন ব্যবহার করা হচ্ছে এরকম কোন সিলিন্ডার কিংবা পরে ব্যবহার করা হবে এমন সিলিন্ডার, যেটিই হোক না কেনো, তা রাখতে হবে নিরাপদ স্থানে। আপনার বাসায় সবসময় বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে সিলিন্ডার রাখতে হবে। কিন্তু সরাসরি সূর্যের আলো পরে, এমন স্থানে রাখা যাবে না। কিংবা আশে পাশে তাপের উৎস রয়েছে, এমন স্থানেও রাখা যাবে না। সিলিন্ডার সবসময় যেকোন দাহ্য পদার্থ থেকে এবং বৈদ্যুতিক সকেট থেকে যথেষ্ট দূরে রাখতে হবে। সিলিন্ডারটি যদি বাইরে রাখতেই হয়, তাহলে এমন কোন প্রকোষ্ঠ (cabinet) এ রাখতে হবে, যার তলায় ভূমি থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে আর চারপাশ তৈরী জালি বা নেটের তৈরী; এতে করে গ্যাস লিক হলে, তা বেরিয়ে যেতে পারে।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ২ :: অবস্থান বা পজিশনিং
এলপিজি পূর্ণ সিলিন্ডারটি সমতল, উলম্বভাবে এবং দৃঢ় কাঠামোর ওপর রাখতে হবে। সিলিন্ডারের তলাটি সকল সময় আনুভূমিক ও সমতল পৃষ্ঠে রাখতে হবে, আর রেগুলেটর এর প্রান্তটি সকল সময় উপরে (উর্ধ্বমুখী) রাখতে হবে। বেশি প্রেশার পাওয়া, তলানির সর্বশেষ গ্যাস টুকু পাওয়া এসব আজগুবি কারণে কখনোই সিলিন্ডারকে আনুভূমিক গড়াগড়ি অবস্থায় রাখা যাবে না। এবং কোন কিচেন ক্যাবিনেটের ভেতের রাখলে, নিশ্চিত করতে হবে খুব সহজে যেনো রেগুলেটর আর ভালব সহজে দেখা যায় এবং সেটিতে হাত পৌঁছে যায়। অনেকে, কিচেন ঝক্ঝকে-তকতকে রাখতে সিলিন্ডার টিকে দুর্গম কোন অবস্থানে ঠেলে-ঠুসে ঢুকিয়ে দেন। যদি খুব ঝক্কি করে ভালব এবং রেগুলেটর ধরতে হয় – তাহলে আপনি বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। অনুগ্রহ করে, সৌন্দর্যকে না বলুন, জানমালের নিরাপত্তাকে হ্যাঁ বলুন, সর্বাগ্রে।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৩ :: লিকেজ ও দিয়াশলাই
বাসায় কেউ যদি বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পায়, তা এলপিজি সিলিন্ডারের লিকেজ এর কারণে হতে পারে। এমতাবস্থায়, লাইটার বা দিয়াশলাই জ্বালিয়ে লিকেজ হয়েছে কিনা নিশ্চিত করা – মারাত্মক বিপজ্জনক। বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পেলে, দরজা-জানালা খুলে দিন এবং সিলিন্ডারের গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করুন। লিক হয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে, সাবান ও পানির মিশ্রণ ব্যবহার সবচে নিরাপদ ও কার্যকরী। যদি কোথাও লিক হয়ে থাকে, সেখান সাবান-পানি-মিশ্রণ ঢাললে বুদবুদ তৈরী হবে আর কোন ক্ষতি ছাড়াই লিক ধরা পরবে। আর যদি সেখানে কোন লিকেজ না থাকে, তাহলে সাবান-পানি মিশ্রণ গড়িয়ে পরে যাবে। লিকেজ পাওয়া গেলে, সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট দক্ষ লোকদের শীঘ্রই খবর দিন আর ব্যবস্থা নিতে বলুন। তারা আসার পূর্বে সম্ভব হলে লিকেজ ওয়ালা সিলিন্ডারটি একটু খোলা বাতাস চলছে এমন স্থানে রাখুন।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৪ :: সিলিন্ডার পরিবর্তন
অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর থেকে নতুন সিলিন্ডার কিনুন। পুরাতন সিলিন্ডার পরিবর্তন করুন। নতুন সিলিন্ডার ক্রয় করার সময় যে অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর থেকে সেবা নিচ্ছেন; নিশ্চিত করুন সিলিন্ডার পুরাতন হয়ে গেলে একই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির থেকে সেবা নিচ্ছেন; প্রয়োজনে তাদের ফোন করে ডেকে নিন। কখনোই, ম্যানুয়াল রিফিলিং করা সিলিন্ডার নেবেন না; কোম্পানি কর্তৃক রিফিল কৃত এবং কোম্পানির সিলযুক্ত সিলিন্ডার ব্যবহার করুন।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৫ :: রক্ষণাবেক্ষণ
সিলিন্ডারটি যত্নসহকারে ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুন। প্রায়শই দেখা যায়, এলপিজি সিলিন্ডারের যন্ত্রাংশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্যা হয়, ত্রুটি হয়, যা আপনার গোচরীভূত হয় না। সাধারণত, এইসকল যন্ত্রাংশের ত্রুটির কারণেই বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিতভাবে সিলিন্ডার ও যন্ত্রাংশের পরীক্ষণ করা উচিত। একজন এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারকারী হিসাবে প্রথমেই দেখুন সিলিন্ডারে কোন অংশ দেবে গিয়ে টোল বা গর্ত মত আছে কিনা। যাকে ইংরেজীতে ডেন্ট (dent) বলে। সিলিন্ডারের গায়ে মরচে বা জং ধরেছে কিনা পরীক্ষা করুন। সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট মেয়াদকাল রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করুন। মেয়াদ শেষ হয়ে আসলে, বদলে নিন। সাধারণত, মেয়াদকাল সিলিন্ডারের তলায় লেখা থাকে। প্রয়োজনে অনুমোদিত অভিজ্ঞ লোক দ্বারা সিলিন্ডার পরীক্ষা করিয়ে নিন। এছাড়া, সংযোগকারী পাইপটি দৃশ্যত ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করুন। ইঁদুরের কামড়ের দাগ দেখতে পেলে, অতিসত্ত্বর বদল করে নিন।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৬ :: পরিবহন ও স্থানান্তর
সিলিন্ডার নামেই যার আকৃতির প্রকাশ, এটি বেলনের মত গোলাকার ও লম্বাটে। যারা এটি পরিবহন এবং স্থানান্তর করেন, তারা কম সময়ে বেশি কাজ করতে গিয়ে প্রায়শই যে ভুলটি করেন, তা হলে সিলিন্ডারটি কাত করে শুইয়ে দিয়ে গড়িয়ে নেওয়া। অথচ, এটি একটি বিপজ্জনক পদ্ধতি যা কখনোই করা উচিত নয়। এছাড়াও সিলিন্ডার কখনো নিক্ষেপ করে এবং হঠাৎ করে নিচে ফেলে দেওয়া যাবে না। এরকম একটি ভিডিও বেশ কিছুদিন পূর্বে ভাইরাল হয়েছিলো, যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন শ্রমিক এক ট্রাক থেকে আরেক ট্রাকে একেকটি সিলিন্ডার ছুঁড়ে ছুড়ে ফেলছিলেন। যেহেতু সিলিন্ডারগুলো নিক্ষেপের পর আপনাআপনি আকাঙ্খিত স্থানে গিয়ে বসে যাচ্ছিল, লোকজন এটিকে দেখে বাহবা দিয়েছেন আর ওই শ্রমিকের কাজের প্রশংসা করতে গিয়ে, ভিডিওটি ভাইরাল করেছিলেন। অনেকে হয়ত বলবেন, সিলিন্ডারগুলো খালি ছিলো। কিন্তু খালি অবস্থায়ও এরকম ছুঁড়ে ফেলা উচিত নয়, এতে করে টোল বা গর্ত (dent) সৃষ্টি হতে পারে, যা পরবর্তীতে সিলিন্ডারকে দুর্বল করে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এবং পরিবহনের সময় সিলিন্ডারের রেগুলেটর ও ভাল্ভ উপরের দিকে রাখতে হবে।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৭ :: ব্যবহারে বিরতি
আপনি বাড়ীর বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন এবং বেশি কিছু বাসায় রান্না হবে না; মানে আপনি বেশি কিছুদিন এলপিজি ব্যবহার করবেন না। তখন নিশ্চিত করুন যে সিলিন্ডারের ভাল্ব বা রেগুলেটর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে। শুধু স্টোভ বা চুলার নব ঘুরিয়ে বন্ধ করা যথেষ্ট নয়, ভাল্ব বন্ধ করুন। এই সু অভ্যাসটি গড়ে তুলুন আর অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখুন।
এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপত্তা ৮ :: আরও কিছু বিষয়
এক সময়ে একটি সিলিন্ডার একটি চুলায় ব্যবহার করুন। বিশেষ ব্যবস্থায় একটি সিলিন্ডার দুইটি চুলায় সংযোগ দেবেন না। অথবা দুইটি ভিন্ন রান্নাঘরে আলাদা চুলায় একটি সিলিন্ডার সংযোগ দেবেন না। সকল সময় অনুমোদিত লো-প্রেসার রেগুলেটর ব্যবহার করুন; যা বিশেষভাবে গৃহস্থালীর কাজের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। কখনোই শিল্প-কারখানায় ব্যবহার্য্য রেগুলেটর বা অন্যান্য যন্ত্রাংশ বাসায় ব্যবহার করবেন না। উন্নতমানের সংযোগ পাইপ (সিলিন্ডার থেকে চুলার সংযোগে) ব্যবহার করুন। ইদানিং ওয়েদার প্রুফ, ওয়্যারমেশ বেষ্টিত নল পাওয়া যায়, টেকনিশিয়ানকে বলুন উন্নত পাইপ ব্যবহার করতে।
আরো কিছু পরামর্শ
সবসময় অনুমোদিত ও স্বনামধন্য কোম্পানির গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করুন। একই কোম্পানির গ্যাস-সিলিন্ডার নিয়মিত ব্যবহার করুন।
আপনার ব্যবহার করা গ্যাস-সিলিন্ডারটি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন।
ব্যবহার করা সিলিন্ডারের গায়ে লাগানো লেবেল পড়ে নিন। প্রতিবার নতুন সিলিন্ডার নেওয়ার আগে ‘সার্টিফিকেশন লেবেল’ যাচাই করে নিন।
সিলিন্ডারের সঙ্গে চুলার সংযোগ দেওয়ার পরও যদি আগুন জ্বলতে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, গ্যাস-লাইনটি বন্ধ করে দিন। তারপর অন্তত ৩ মিনিট রান্নাঘরের জানালা খুলে রাখুন। এরপর নতুন করে আগুন ধরানোর চেষ্টা করুন। কোনো অবস্থাতেই জানালা বন্ধ রেখে চুলা জ্বালাবেন না। বাতাস চলাচল না থাকলে গ্যাস সিলিন্ডারের আগুন থেকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
প্রতিটি গ্যাস-সিলিন্ডার প্রতি ১০ বছরের মধ্যে একবার হলেও অনুমোদিত এলপিজি টেস্ট স্টেশন থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিন। সর্বশেষ পরীক্ষার তারিখটি সিলিন্ডারের গায়ে স্পষ্টভাবে লিখে রাখুন।
গ্যাস-সিলিন্ডার সবসময় খাড়াভাবে রাখতে হবে। এমনকি পরিবহনের সময়ও এই নীতি মানতে হবে। অবশ্য বিশেষভাবে তৈরি কিছু সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলেও সমস্যা নেই।
এলপি গ্যাস-সিলিন্ডার মজুদ করতে চাইলে অবশ্যই এমন স্থানে রাখতে হবে, যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল আছে এবং অতিরিক্ত তাপ ও অন্যান্য কম্প্রেস গ্যাস থেকে দূরে রাখতে হবে।